চাঁদাবাজদের অত্যাচারে চট্টগ্রাম ছাড়ছেন ব্যবসায়ী দম্পতি

গতকাল বুধবার (৩১ জানুয়ারি) শীতের বিকেল। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে সূর্যের আলো তখন প্রায় নিভে গেছে। চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী থানার আব্দুরপাড়া এলাকার নিজ বাড়িতে অসুস্থ স্বামীর পরিচর্যা করছিলেন লতিফুন্নেসা। তাঁর মাথায় ভর করেছে নানা দুশ্চিন্তা। কারণ, সব মায়া ত্যাগ করে কয়েক দিন পরই এই বাড়ি ছাড়বেন তিনি। বিক্রি করে দিয়েছেন জমানো টাকায় তৈরি করা বাড়িটি।

গেটের ভেতরে গিয়ে এই প্রতিবেদক বাড়ি ছাড়ার নেপথ্যের কারণ জানতে চাইলে আলাপচারিতায় উঠে আসে স্থানীয় চাঁদাবাজদের একটি চক্রের পাল্লায় পড়ে ভিটে ছেড়ে যাওয়ার গল্প। লতিফুন্নেসার বাড়িটি পাহাড়তলী থানার আব্দুরপাড়া এলাকায়। বাড়িটি ১০ কাঠার ওপর।

স্বামী সফিক উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরী অনেক দিন ধরে অসুস্থ। লাঠিতে ভর করে চলতে হয় তাঁকে। তাঁকে নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে লড়াইটা একাই চালিয়ে যাচ্ছেন লতিফুন্নেসা। লড়াইয়ের মধ্যেই যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে চেহারায়। কিন্তু দমে যাননি তিনি। চাঁদাবাজেরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও দিয়েছে একাধিক। এসব মামলা থেকে নিজেকে খালাস করিয়েছেন। নিজেও মামলা করেছেন চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে।

সেই মামলা তদন্ত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট। সংস্থাটির পরিদর্শক (প্রশাসন) কাজী এনায়েত কবীরের তদন্তে উঠে আসে দুই আসামির নেতৃত্বে চাঁদাবাজির সত্যতা। তদন্তকালে চাঁদাবাজির প্রমাণ-সংক্রান্ত মোবাইলে ফোনের কথোপকথনও হাতে আসে পিবিআইয়ের। সম্প্রতি সংস্থাটি মামলার প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে আসামি করা হয় মো. মাঈন উদ্দিন রিপন ও মো. বাবলু নামের দুজনকে। আদালত থেকে জারি হওয়া পরোয়ানার ভিত্তিতে গত ২৪ জানুয়ারি মাঈন উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পাহাড়তলী থানা-পুলিশ। পরে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। বর্তমানে আদালতের নির্দেশে কারাগারে রয়েছেন মাঈন উদ্দিন।

পিবিআইয়ের তদন্ত ও প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, লতিফুন্নেসার স্বামী সফিক উদ্দিন আহাম্মদ চৌধুরীর বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায়। তিনি প্রথমে চাকরি করতেন। পরে সিমেন্টের ব্যবসা করেন। নব্বইয়ের দশকে ব্যবসার সুবাদে চট্টগ্রামের বাসিন্দা মাঈন উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। মাঈন উদ্দিন নিজেও সিমেন্টের ব্যবসা করতেন।

ব্যবসায় সফলতা পেলে মাঈন উদ্দিনের পরামর্শে ১৯৯৭ সালে পাহাড়তলী থানার আব্দুরপাড়া এলাকায় এক খণ্ড জমি কেনেন সফিক। ২০১২ সালে সেই জমিতে বাড়ির কাজ শুরু করেন। জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে ধীরে ধীরে নির্মিত হতে থাকে বাড়িটি। তবে নির্মাণকাজ শুরুর দুই বছর পর থেকে মাঈন উদ্দিন সেখান থেকে জায়গা দাবি করে নির্মাণকাজে বাধা দেন।

২০১৬ সাল থেকে সফিক আহাম্মদ ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা মামলা শুরু করেন মাঈন উদ্দিন। শ্লীলতাহানি থেকে চাঁদাবাজি কোনো মামলাই বাদ যায়নি। যদিও এসব মামলায় পুলিশ ঘটনার সত্যতা না পেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শুধু মামলা নয়, নানা সময়ে সফিক দম্পতিকে হুমকি-ধমকি দিত মাঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি চক্র।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, পাহাড়তলী থানার আব্দুরপাড়ার শেষ দিকের তিনতলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। ছয়তলা পর্যন্ত করার কথা থাকলেও এখন নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। সফিক ও তাঁর স্ত্রী লতিফুন্নেসা বলেন, চাঁদাবাজদের চক্রে পড়ে এখন বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁরা। প্রায় সাত কোটি টাকা দামের হলেও চাঁদাবাজদের বাধার কারণে মাত্র সাড়ে চার কোটি টাকা দিয়ে জমিসহ বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। বায়না বাবদ ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। বাকি লেনদেন সম্পন্ন হলে শিগগিরই এই বাড়ি ছাড়বেন তাঁরা।

একই এলাকায় আরও অন্তত চারটি পরিবার এই চক্রের খপ্পরে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সবার ক্ষেত্রে কৌশল একই। বাইরের কোনো লোক এই জায়গায় জমি কিনলে তাতে সহযোগিতা করেন তাঁরা। জমিটি নেওয়ার পর বিপত্তি বাধে যখন কেউ বাড়ি করতে যান। বাড়ির কাজ শুরু করলেই জায়গা পাবেন বলে অভিযোগ তুলে মিথ্যা মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। টাকা দিলে মামলা মীমাংসা; না দিলে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়, হয়রানি করা হয়।

লতিফুন্নেসার বাড়ির পাশের এক বাসিন্দা (নাম প্রকাশ করেনি) ১৯৯৭ সালে এখানে জমি কেনেন। ২০১৪ সালে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যে এই চক্রের সদস্যরা জায়গা পাওয়ার অজুহাত তুলে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দিলে ওই বছরই মামলা করা হয়। অসহায় পরিবারটি বাধ্য হয়ে ২০ লাখ টাকা দিয়ে তাঁদের সঙ্গে ঝামেলা মীমাংসা করে।

সফিকের স্ত্রী লতিফুন্নেসা বলেন, ‘বর্তমানে আমার স্বামী অসুস্থ। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেন না। বাড়িতে আমার এক কন্যা রয়েছে। বলতে গেলে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আমি একাই সংগ্রাম করছি। তাদের অত্যাচারে এই বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছি। বায়নার টাকা দিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে হজ করেছি। শিগগিরই বাড়ি ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে যাব।’

বৃদ্ধ সফিক আহাম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘অনেক শখ করে বাড়িটি করেছিলাম স্থায়ীভাবে বসবাস করতে। বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে, কখনো কল্পনা করিনি। কিন্তু এখন একবুক কষ্ট নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম ছাড়তে হচ্ছে।’

সম্প্রতি চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবীর লেখেন, মামলার পর তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অন্তত ১২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে কল রেকর্ড বিশ্লেষণ করেছেন। সার্বিকভাবে তাঁর তদন্তে উঠে আসে আসামি মাঈন উদ্দিন ও তাঁর সহযোগী সফিক দম্পতির কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক কাজী এনায়েত কবীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘তদন্ত করে যা পেয়েছি, মামলার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।’

২৪ জানুয়ারি থেকে কারাগারে আছেন অভিযুক্ত মাঈন উদ্দিন। এ কারণে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, জমি কিনলে বা নতুন বাড়ি তুললে চাঁদাবাজদের একটি চক্র ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা দাবি করার ঘটনা চট্টগ্রামে বেড়েছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপর হওয়া দরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) আ স ম মাহতাব উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেন ঘর ছেড়ে যাবে। চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। কেউ অভিযোগ দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।’

You May Also Like