সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যত ছাত্র-জনতার মৃত্যু হয়েছে, দেশের ইতিহাসে কোনো অরাজনৈতিক দাবির কারণে এত মানুষের মৃত্যু হয়নি। সংবিধানে সভা-সমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতি পদে পদে সংবিধান বরখেলাপ করে যাচ্ছে সরকার। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের ঘটনায় গুলি চালিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছে। এর বিচার হওয়া উচিত।
আজ সোমবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এক মানববন্ধনে আইনজীবীরা এসব কথা বলেন। ‘গণহত্যার বিচার চাই, গায়েবী মামলা-গ্রেপ্তার ও নির্যাতন বন্ধ কর’ শিরোনামে এই মানববন্ধনের আয়োজন করে আইনজীবী সমাজ।
সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে ছাত্ররাই কিন্তু দেশের স্বাধীনতার পতাকা প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলেছিল। ছাত্ররাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিল বটতলা থেকে। পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত দেখিনি যে একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক দাবির কারণে এতগুলো ছাত্রকে হত্যা করা হয়।’
রাতের অন্ধকারে ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার সমালোচনা করে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘কোন অধিকারে, কোন আইনে ব্লক রেইড দিয়ে তুলে নেওয়া হচ্ছে? আমরা এর ধিক্কার জানাই।’ রক্তের বিনিময়ে যে সংবিধান অর্জন করা হয়েছে, প্রতি পদে পদে সরকার তার বরখেলাপ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদেরও সমালোচনা করেন জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, ‘তোমাকে (হারুন) জানিয়ে দিতে চাই, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দিকনির্দেশনা আছে। তা অমান্য করে তুমি সেই ছয়জন সমন্বয়কারীকে আটক রেখেছ। এর কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে।’
সম্প্রতি পুলিশের এক সদস্য হত্যা মামলায় ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। সেই প্রসঙ্গ টেনে নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রতি আপিল বিভাগের দিকনির্দেশনা মানার আবেদন জানিয়ে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘কথায় কথায় গ্রেপ্তার করে, বয়স কত সেটা না দেখে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। রিমান্ড পর্যন্ত দিচ্ছেন। এর জন্য কিন্তু কৈফিয়ত দিতে হবে।’
আন্দোলন করতে গিয়ে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি শোক প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে চাই, তাঁরা (শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ) কেন মরল, কয়জন মরল, কোথায় মরল, কার হাতে মরল। হাজারো শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ গণগ্রেপ্তারের মুখে পড়েছেন। গতকাল শুনেছি, ঢাকার আদালতে একজনেরও জামিন মঞ্জুর করা হয়নি।’
সংবিধান মানুষকে জীবনের, ব্যক্তিস্বাধীনতার, সভা-সমাবেশ করার, বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শুনছি না যে কেউ মরেছে। শুধু শুনছি, স্থাপনাদি নষ্ট হয়েছে। স্থাপনার জন্য কান্নাকাটি, স্থাপনার জন্য যত সবকিছু করা হচ্ছে। কিন্তু কতজন মরল, কেন, কোথায়, কার হাতে—আদৌ আমরা এ তথ্য পাব কি না, তা জানি না। প্রতিকার তো দূরের কথা।’
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ‘পুলিশের নির্বিচার গুলিতে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি’ শোক প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তোবারক হোসেন। আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ছাত্ররা যখন একটি নিরীহ দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন, তখন একজন মন্ত্রী একটি ছাত্রসংগঠনকে লেলিয়ে দিলেন। সেখান থেকে গন্ডগোল ও অরাজকতার সূত্রপাত। এরপর নির্বিচার পুলিশের গুলি। তার পরিণতিতে দেশে নামানো হলো বিজিবি, সেনাবাহিনী এবং জারি করা হলো কারফিউ। এসব অসাংবিধানিক, অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফৌজদারি অপরাধ করা হয়েছে দেশের মানুষের সঙ্গে। এর বিচার হওয়া উচিত।
ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আন্দোলনকারী ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে বক্তব্য দেওয়ানোকে ‘আরেকটি নাটক’ হিসেবে মন্তব্য করে তোবারক হোসেন বলেন, ‘ওরা যদি আন্দোলনে জয়লাভ করে থাকে, তাহলে সেই জয়ের ঘোষণা করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ডিবি হেফাজতে কেন? এটা কি আমরা বুঝি না? দেশবাসী কি এতই বোকা?’
আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, প্রতিটি হত্যার তদন্ত ও দায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও করেন তিনি। মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক জনগণের করের টাকায় হয়েছে উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজুর আল মতিন বলেন, এত মানুষ কেন মরল, তার জবাব সরকারকে দিতে হবে।
মানববন্ধনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আইনজীবী অনীক আর হক। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, গুলি করার পাশাপাশি গণগ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এসব ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আবশ্যকতা রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের শিক্ষক, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের কয়েকজন প্রতিথযশা ব্যক্তির সমন্বয়ে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।