বাংলাদেশে সমকামীদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক আইনত নিষিদ্ধ। সমকামীরা সেখানে নিগ্রহের ভয়ে সাধারণত তাদের যৌন পরিচয় প্রকাশ করেন না। গত বছর বাংলাদেশ দুজন নেতৃস্থানীয় সমকামী অধিকার কর্মীকে হত্যা করে জঙ্গিরা। শুক্রবার ঢাকার কাছে কেরানিগঞ্জে এক অনুষ্ঠান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২৭ জনকে। বাংলাদেশে একজন সমকামী আসলে কতটা নিরাপদ? সমাজ এবং পরিবার কী আচরণ করে তাদের সঙ্গে? নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক সমকামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র বিবিসিকে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে:
“আমি যে সমকামী, সেটা আমার পরিবার জানে। আমার বন্ধুরাও জানে। আমি যে সমকামী এবং সেম সেক্স একটিভিষ্ট, এটা জানার পর আমি আমার পরিবারের বিষফোঁড়ায় পরিণত হলাম।
আমার বন্ধুরা, ছোট থেকে যাদের সাথে এক সঙ্গে বড় হলাম, তারা আমাকে ছেড়ে দিল।
আমার বন্ধুরা আমাকে দেখতে পারে না। আমি যখন শুক্রবার মসজিদে নামাজ পড়তে যাই, তখন আমাকে বলে, তুমি মসজিদে আসছো কেন? ওরা আমাকে আমার নাম ধরে পর্যন্ত আর ডাকে না।
আমি তখন স্কুলে পড়ি। তখন আমি টের পাই, আমি অন্য স্বাভাবিক মানুষের মতো নই। আমি একটা ভুল শরীরে জন্মগ্রহণ করেছি।
আমি আমার বাবাকে কেঁদে কেঁদে সব খুলে বললাম। বাবা সব শুনে বিষয়টা পজিটিভলি নিয়েছে।
বাবা তখন আমাকে বুঝিয়ে বললো, তুমি যেটা করছো, সেটা আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে, আমাদের ধর্মে গ্রহণযোগ্য নয়। আমি দেখি তোমাকে বাংলাদেশ থেকে কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারি কীনা।
২০১১ সাল থেকে আমার মা আমার সঙ্গে কথা বলেন না। একদম কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমার বাবা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি আনন্দিত যে আমার বাবা আমাকে ফেলে দেননি।
কিন্তু আমার মা এটা মেনে নিতে পারেন নি যে আমি কখনোই কোন মেয়েকে বিয়ে করবো না। আমি একটা ছেলের সঙ্গে থাকবো। আমি কখনো কোন সন্তানের জন্ম দিবো না। এটার জন্য মা মন খারাপ করে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিস কোরান পড়ে মা যা বুঝেছে, সে বিশ্বাস করে যে, এটা অবৈধ, খারাপ। সেজন্য মা আমার সঙ্গে কথা বলে না।
আমি মুসলিম পরিবারের ছেলে। আমার আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছে সমকামী করে। মেডিক্যাল সায়েন্স বলে, একজন মানুষ কিন্তু মার্তৃগর্ভ থেকেই সমকামী হিসেবে জন্ম নেয়। এটা মানসিক রোগ নয়।
আমার একটা ছোট বোন আছে। এখনো ছোট। অনেক কিছু বোঝে না। কিন্তু আমি চাই সে এমন ভাবে বড় হোক, যাতে আমাদের বুঝতে পারে।বাংলাদেশের মানুষ যখন জানতে পারে কোন মানুষ সমকামী, তখন তারা ভয় পায়। আমরা স্বাভাবিক মানুষ। আমরা ভয়ের কোন কারণ নই। আমাদের সেক্সুয়াল আচরণ এবং দৈহিক গঠন, দুটাই স্বাভাবিক। সমকামিতা পুরোটাই স্বাস্থ্যকর, এটা অস্বাস্ব্যকর নয়।
বাংলাদেশে আমরা যারা সমকামী, তারা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি। আমরা আমাদের নিজের দেশে যতক্ষণই বেঁচে আছি, আমাদের মনে হয় আমরা নিরাপদ নই।
এদেশে এখনো আমাদের ‘ভূমিকম্পের’ কারণ বলে গণ্য করা হয়।
কেরানিগঞ্জে যেটা ঘটেছে সেটা খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা, খুবই খারাপ একটা বিষয়। আমরা এরকম অনুষ্ঠান করে থাকি।
আমরা তাহলে কোথায় অনুষ্ঠান করবো? আমরা যদি থানায় গিয়ে বলি যে আমরা লেসবিয়ান ও গে রাইট এক্টিভিষ্টরা একটা অনুষ্ঠান করতে চাই, আমাদের তো পারমিশন দেবে না।
আমি গত বছর মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলাম, হিউম্যানিটারিয়ান প্যারোলের আবেদন করার জন্য। জুলহাস মান্নান এবং তনয় খুন হওয়ার পরপরই কিছু অপরিচিত মানুষ আমাকে ফলো করেছিল। আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার ঠিকানা বদল করেছিলাম। বাসায় থাকতাম না। আমি বাধ্য হয়েছিলাম মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে সাহায্য চাইতে। ওরা আমাকে হেল্প করেছে কিছু ইনফরমেশন দিয়ে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমি কেন নিজের দেশে থাকতে পারবো না। আমি আসলে কি, সেটা কেন আমাকে অন্য দেশে গিয়ে প্রকাশ করতে হবে।
আমি এখন পরগাছার মতো। মা পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন জন। সেই মা আমাকে দেখতে পারে না। ছেলে সমকামী সেই অপরাধে মা কথা বলে না। কাজেই সেই বাসায় থাকা না থাকা একই কথা। আমি বাসায় খুব কম থাকি এখন।
আমার দেশে সমপ্রেমের সাতকাহনের কোন জায়গা নেই। যেখানেই যাই, আমাদের মেরে ফেলবে।”