হামলা-সংঘর্ষে নিভল ৬ প্রাণ

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল মঙ্গলবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন চার শতাধিক। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কোথাও ছাত্রলীগ-যুবলীগ, কোথাও পুলিশ এসব সংঘর্ষে জড়ায়। নিহতদের মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় দু’জন ও রংপুরের একজন রয়েছেন। এদিকে আন্দোলনকারীরা প্রথমে জানিয়েছিল, পবিত্র আশুরার কারণে আজ বুধবার কর্মসূচি স্থগিত থাকবে। তবে রাতে তারা ঘোষণা দেয়, আজ দুপুরে রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল কর্মসূচি থাকছে।

রাজধানীর মহাখালীতে অবরোধের কারণে ঢাকার সঙ্গে সাত ঘণ্টা রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর ঘরে ফেরা কর্মজীবীরা পড়েন ভোগান্তিতে।

এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোমবার রাত থেকেই ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। উপাচার্যের বাসভবনে আশ্রয় নেওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ বহিরাগতরা। পরে হল থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে এলাকা ছাড়ে।

এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগের কক্ষ ভাঙচুর করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আন্দোলনকারীরা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদকের কক্ষে তল্লাশিও চালান।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ-র‍্যাবের পাশাপাশি বিজিবি টহল দিয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন সতর্ক প্রহরায়। রাত ১২টার দিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় দলের সাত নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। শতাধিক ককটেল এবং কয়েকটি দেশি-বিদেশি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে সকালে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ছাত্রদল সর্বাত্মকভাবে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের পাশে রয়েছে।

এদিকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে হলত্যাগের নির্দেশ। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণি কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় সব শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর ওপর গেল সোমবার হামলার প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকার সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছে দফায় দফায়। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ও কোটা সংস্কারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী– উভয় পক্ষের হাতে ছিল লাঠিসোটা ও দেশি অস্ত্রশস্ত্র। কারও হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা যায়। বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা কলেজের সামনে থেকে আহত এক যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মাথা ও মুখে জখমের চিহ্ন ছিল। পরে আঙুলের ছাপের মাধ্যমে মধ্যরাতে পরিচয় শনাক্ত হয়। তাঁর নাম সবুজ আলী (২৪)। ওই যুবকের গ্রামের বাড়ি নীলফামারী সদরে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতাল থেকে আহত আরেকজনকে ঢামেকে নেওয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয়। যারা তাঁকে হাসপাতালে নিয়েছেন তাঁরা জানান, ওই তরুণ সিটি কলেজের সামনে আহত হন। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া সমকালকে বলেন, পপুলার থেকে যে যুবককে ঢামেকে আনা হয়েছে, রাতে তাঁর পরিচয় শনাক্ত করেছেন স্বজনরা। মো. শাহজাহান (২৪) নামে ওই যুবক স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কামরাঙ্গীরচর থাকতেন। তিনি পেশায় হকার।

শাহজাহানের মা আয়শা বেগম বলেন, নিউমার্কেটের বলাকা সিনেমা হলের সামনে পাপোশ বিক্রি করত আমার ছেলে। কীভাবে মারা গেছে, জানি না।
চট্টগ্রামে নিহত তিনজনের মধ্যে দু’জনের পরিচয় মিলেছে। তাঁরা হলেন মো. ফারুক (৩২) ও মো. ওয়াসিম (২২)। ফারুক একটি আসবাবের দোকানের কর্মচারী। তাঁর শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক।

রংপুরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২২) নিহত হয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলন সমন্বয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সাঈদের মৃত্যুর ঘটনার জেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও সেখানে থাকা কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।

এদিকে রাজধানীর ধানমন্ডি, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, মেরুল বাড্ডা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনে, যাত্রাবাড়ীর কাজলা, বিমানবন্দর গোলচত্বর, শান্তিনগর, মতিঝিল শাপলা চত্বর, উত্তরা, মহাখালীসহ আরও কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। এতে সড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ হলে ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে। মহাখালীতে দুপুরের দিকে রেললাইন অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে দেশের বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে রাজধানীর রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রাত ৮টার দিকে রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ আহত ১২৬ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আটজন ছাড়া বাকি সবাই প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতাল ছেড়েছেন। সংঘর্ষে আহত হন ১২ পুলিশ সদস্য।

সংঘাত প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, কোটা আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ইন্ধন দিচ্ছে। তারা নির্বাচনে আসে না। বাইরে থেকে হইচই করে। তবে আন্দোলনকারীরা কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সায়েন্স ল্যাব রণক্ষেত্র

কোটা সংস্কার দাবি ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সায়েন্স ল্যাবে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজসহ অন্তত আট কলেজের শিক্ষার্থীরা রড, লাঠিসোটা হাতে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করতে থাকেন। নিউমার্কেট ও এলিফ্যান্ট রোডে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ২টার দিকে এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালে ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা রড, লোহার পাইপসহ লাঠিসোটা নিয়ে জড়ো হলে সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় এলিফ্যান্ট রোডের কিছু ব্যবসায়ীকেও এতে যুক্ত হতে দেখা যায়। একপর্যায়ে পুলিশ বক্সে ভাঙচুর করেন আন্দোলনকারীরা।

দুপুর আড়াইটায় শিক্ষার্থীরা এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের ধাওয়া করলে তারা পিছু হটেন। এর পর ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা পাল্টা আন্দোলনকারীদের ধাওয়া করতে থাকেন। ২টা ৪০ মিনিটে আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি অস্ত্র উঁচিয়ে পরপর তিন রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলির শব্দে শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাবের দিকে চলে যান। ২টা ৫৫ মিনিটে আন্দোলনকারীরা এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থানকারীদের ফের ধাওয়া দেন। এ সময় একই ব্যক্তি আরও তিন রাউন্ড গুলি ছুড়লে শিক্ষার্থীরা ফিরে যান সায়েন্স ল্যাবে। এদিকে ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগের সঙ্গেও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় গুলির ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। আহতদের আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর পর পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে ফের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। রাত ৯টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বিকেলে ঢাকা কলেজের সামনের রাস্তায় একদল লোককে এক ব্যক্তিকে পেটাতে দেখেন তারা। পরে ওই ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমকে ধাওয়া করেন শিক্ষার্থীরা। তিনি ধানমন্ডির ল্যাবএইডে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। ডাক্তার দেখিয়ে বের হলে শিক্ষার্থীরা তাঁকে ধাওয়া করলে হাসপাতালে ঢুকে পড়েন। এ সময় তাঁর গাড়িও আটকে দেওয়া হয়।

দিনভর যেমন ছিল ঢাবি 

গতকাল বিকেল ৩টার দিকে রাজু ভাস্কর্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পূর্বনির্ধারিত বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। পরে ছাত্রলীগও দুপুর দেড়টায় সেখানে কর্মসূচির ডাক দেয়। এর পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরিয়ে নেন সমাবেশ। শিক্ষার্থীরা বিকেলে শহীদ মিনারে জড়ো হলে ছাত্রলীগও রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হয়। মহানগর ছাত্রলীগ ছাড়াও ইডেন মহিলা কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ কর্মীরা সেখানে সমবেত হন। অনেকের হাতে ছিল লাঠিসোটা, বাঁশ, স্টাম্প, হকিস্টিক ও স্টিলের পাইপ।

দুপুর দেড়টার দিকে ভিসি চত্বরের দক্ষিণে মলচত্বর এলাকায় প্রতিটি হল থেকে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ফুলার রোড হয়ে শহীদ মিনারে মিছিলে যোগ দেন। এ সময় ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বহন করা দুটি বাস ভাঙচুর করা হয় ভিসি চত্বরে। সহিংসতা এড়াতে হল থেকে ছাত্রীরাও বের হননি। এদিকে শহীদ মিনারে ইডেন মহিলা কলেজ, হোম ইকোনমিকস কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। ঢাকা নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস এলাকায় মিছিল করেন। রাত ৮টার দিকে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মিছিল নিয়ে ফুলার রোড হয়ে ভিসি চত্বরে অবস্থান নেন। সেখানে বেশ কয়েকজনকে মারধর করা হয়। এ সময় বেশ কিছু সংখ্যক বহিরাগতকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা যায়।

মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মহাখালী এলাকায় রেলপথ অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তিতুমীর সরকারি কলেজসহ আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা এতে অংশ নেন। সোয়া ১টার দিকে তারা সেখানে দুটি ট্রেন আটকে দেন। সাড়ে ১২টার পর ঢাকা থেকে সারাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ২টার দিকে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। আন্দোলনকারীরাও পাল্টা হামলা করেন। থেমে থেমে সংঘর্ষ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই এলাকার সড়কে যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল দুপুর ২টার দিকে তেজগাঁও কলেজসহ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ফার্মগেটে সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আড়াইটার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। কিছু শিক্ষার্থী ফার্মগেটে মেট্রোরেল স্টেশনে গিয়ে আশ্রয় নেন। এ সময় একদল যুবক স্টেশনের মধ্যে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়।

চানখাঁরপুলে চারজন গুলিবিদ্ধ

বিকেলে চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তারা হলেন পলক সানজিদ শুভ, অয়ন, সাফিন ও রাতুল। তাদের ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বিকেল সাড়ে ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সামনের সড়ক পর্যন্ত সমবেত হন শিক্ষার্থীরা। অবশ্য আগে থেকেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওমর বিন আবদাল আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চানখাঁরপুল মোড়ে অবস্থান নেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীর অবস্থান থেকে বিকেল ৫টার দিকে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সংঘর্ষের সময় তিন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া আরও কয়েকজন আহত হন। আন্দোলনকারীরা সন্ধ্যা ৭টার দিকে চানখাঁরপুল মোড়ে কাঠ-বাঁশ দিয়ে সড়কে আগুন ধরিয়ে দেন। কয়েকটি দোকানও ভাঙচুর করেন তারা।

নতুন বাজারে সংঘর্ষ

সকাল ১০টার দিকে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নতুন বাজারে সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ১১টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করেন। একপর্যায়ে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। থেমে থেমে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বিকেল ৫টার দিকে শিক্ষার্থীরা চলে যান।

মতিঝিলে ৪ ঘণ্টা অবরোধ

দুপুর ১টার দিকে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় চারদিকের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল ৫টার দিকে তারা সড়ক থেকে সরে যান। পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আবুল হাসান সমকালকে বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নেন। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ৫টার দিকে তারা চলে যান।

গাবতলীতে বিক্ষোভ

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গাবতলীতে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ঢাকায় প্রবেশের অন্যতম এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর ১টার দিকে আন্দোলনকারীরা চলে যাওয়ার পর যান চলাচল শুরু হয়। এ ছাড়া সকাল ১০টার পর উত্তরা, বিমানবন্দর গোলচত্বর, কাওলা, কুড়িল বিশ্বরোড, নতুন বাজার, মেরুল বাড্ডা, বনানী, যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪সহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এসব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। দুর্ভোগে পড়েন মানুষ।

হামলায় আহত ঢাবির পাঁচ শিক্ষক

আন্দোলনকারীদের হামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন। আহত শিক্ষকরা হলেন– অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক ড. আবদুল মুহিত, সহযোগী অধ্যাপক ড. ফারজানা আহমেদ শান্তা, সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসান ফারুক ও সহকারী অধ্যাপক ইমামুল হক সরকার টিটু। প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান জানান, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের সামনে আন্দোলনকারীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা করেন। আহতরা ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রক্টরিয়াল বডির শিক্ষকরা শহীদ মিনার এলাকায় বহিরাগতদের তাড়াতে গেলে তাদের ধাওয়া করেন আন্দোলনকারীরা। পরে কিছু শিক্ষার্থীর লাঠিপেটায় তারা পিছু হটেন। শিক্ষকদের কয়েকজনের মাথায় আঘাত লেগেছে।

সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে আহত ৫ জন

সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী তাদের ওপর হামলা চালান। দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত পাঁচজন মেডিকেলের ছাত্রী আহত হন। এর পর আরও ফুঁসে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। হামলাকারীদের বহিষ্কারের দাবি তুলে শিক্ষার্থীরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয় ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকেন। তখন কার্যালয়ে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শাহাদাত হোসেন রিপন, উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আকাইদুল ইসলাম, কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন অবস্থান করছিলেন। রাত ৮টা পর্যন্ত তাদের ওই কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। ৮টা ৫ মিনিটে পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে। এ সময় আন্দোলনকারীরা চলে যান।

জবিতে হামলায় ৪ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীর ওপর গুলি চালানো হয়েছে। এতে জবির তিন ও সরকারি কবি নজরুল কলেজের এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে জবির সহস্রাধিক শিক্ষার্থী লাঠিসোটা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে রায়সাহেব বাজার অতিক্রম করছিলেন। এ সময় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গুলিও চালায় তারা। এতে জবির ১৭ ব্যাচের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র অনিক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ১৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফেরদৌস জামান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ১৬ ব্যাচের নাসিম ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী হাসিব গুলিবিদ্ধ হন। তাদের ন্যাশনাল মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর ঢামেক হাসাপাতালে পাঠানো হয়। এ ছাড়া ছুরিকাঘাতে তায়াফ নামে জবির এক শিক্ষার্থী আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেলে ভর্তি রয়েছেন।

ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. আরিফ বলেন, গুলিবিদ্ধ চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদিকে গুলিবিদ্ধ দু’জনকে ঢামেক হাসপাতালে অপারেশন করা হয়েছে বলে জানায় প্রক্টরিয়াল বডি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমরা আহত শিক্ষার্থীদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছি।

এদিকে জবি শাখার নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাবির টিএসসির উদ্দেশে দুপুরে চলে যান। এ সময় পুরান ঢাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে জবির সামনে শোডাউন দিতে দেখা যায়। আন্দোলনকারীরা তাঁতীবাজারে অবস্থান নিলে সেখানে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।

কয়েকটি ফ্লাইট ছেড়েছে দেরিতে 

রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধের কারণে অনেক যাত্রী নির্ধারিত ফ্লাইট ধরতে পারেননি। যাত্রীরা সময়মতো না পৌঁছায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের কয়েকটি ফ্লাইট ছেড়েছে দেরিতে। শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে বেশ কয়েকটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ ছিল। সেসব সড়কে বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানবন্দরে আনতে এপিবিএন, ডিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগ, এভিয়েশন সিকিউরিটির (এভসেক) সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।’

নেতারা যা বলছেন 

বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হয়েছে। তাদের কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখন যারা আন্দোলন করছে, তারা রাজাকারদের প্রেতাত্মা। তারা কোটা সমস্যার সমাধান চায় না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ হাসান বলেন, আমরা এখনও অহিংস আন্দোলনে আছি। তবে আমাদের ওপর যদি হামলা হয়, কোনো উস্কানি আসে, আমরা এর জবাব দিতে প্রস্তুত। আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ব।

আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, পুলিশ ও ছাত্রলীগের যৌথ হামলা ও গুলিবর্ষণে নিহতদের জন্য আজ দুপুর ২টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল হবে।

You May Also Like