হামলা-সংঘাতের বিকল্প কি কিছুই নেই?

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। তবে ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিল সরকার। এরও প্রায় তিন বছর পর ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। গত ৫ জুন এই রিটের রায় প্রকাশিত হয় এবং পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকেই মূলত আবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলন করছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

বলে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কোনোভাবেই সহিংসতামূলক ছিল না। কিন্তু গত তিন দিনে সহিংস হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের এবং পুলিশি হামলায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন এবং হাসপাতালে গিয়েও ছাত্রলীগ আক্রমণ করেছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

আন্দোলন নতুনভাবে মোড় নেয় কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এ নিয়ে স্লোগান শুরু হয়। তবে পরের দিন এই স্লোগানে কিছু পরিবর্তন আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেদিন রাত ১০টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে বের হয়ে টিএসসিতে জমায়েত হতে শুরু করে। সেদিন কোনো ধরনের সহিংসতা হয়নি। ছাত্রী হলে মেয়েরা রাত ২টার দিকে ফিরে আসে। পরের দিন পরিস্থিতি আরও উত্তাপ ছড়ায়। তখন আর বিষয়টি কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। মূলত ‘রাজাকার’ বিষয়টি নিয়েই মিছিল এবং পরবর্তী স্লোগান ছিল– ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ এবং তারা প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি তোলে।

এর পর থেকেই মূলত প্রতিক্রিয়া এবং পরবর্তীকালে সহিংসতা। তবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশনাও ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগ প্রস্তুত। ক্ষমতাসীন দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার এমন নির্দেশ সহিংসতার বৈধতাকেও সামনে আনে।

শেষ পর্যন্ত আন্দোলন এসে ঠেকেছে ‘রাজাকার’ ইস্যুতে। অনেকেই বলেছেন, শিক্ষার্থীরা কেন এই স্লোগান দেবে? আবার কেউ কেউ বলেছেন, এগুলো আসলে এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান। তবে এটি নিয়ে আলোচনা করে তাদের ওপর নিপীড়নকে বৈধ করা যাবে না।

একটি বিষয় খুব পরিষ্কার এবং দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই। তা হলো, কোনোভাবেই কারও ওপর নিপীড়ন করা যাবে না। ক্যাম্পাসে সবার নিরাপত্তা বিধান করা প্রশাসনের দায়িত্ব। কাউকে শাসন করার দায়িত্ব কোনো সংগঠনের ওপর কোনোভাবেই বর্তায় না। তাই এ ধরনের নিপীড়ন এবং সহিংসতার প্রতি সমর্থনের কোনো ধরনের সুযোগ বা যুক্তি তৈরির বাহানা থাকার অবকাশ নেই।

এটিও বলা প্রয়োজন, কোনো গণআন্দোলনে কিছু সতর্কতা থাকা আন্দোলনের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এমন কোনো স্লোগান কিংবা কর্মসূচি না দেওয়াই ভালো যেটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরি হয়ে আন্দোলনটির প্রতি মানুষের সমর্থন কমে যেতে পারে। কারণ ‘রাজাকার’ আমাদের দেশের অস্তিত্বের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত একটি নেতিবাচক শব্দ। তাই এই শব্দের বিনির্মাণ বা ভিন্ন বোধ তৈরির মনস্কতাও ঝুঁকি তৈরি করে। কারণ এগুলোর মীমাংসা ১৯৭১ সালে হয়ে গেছে। তাই ব্যঙ্গাত্মক কিংবা স্যাটায়ার হিসেবে এ ধরনের শব্দের ব্যবহার আন্দোলনের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। আমি ধরেই নিচ্ছি, শিক্ষার্থীদের এ শব্দের প্রতি ঘৃণা রয়েছে বলেই তারা প্রতিবাদে এ শব্দটিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। তবে এটি না হওয়াই ভালো ছিল হয়তো। কিন্তু প্রতিটি ক্যাম্পাসে যা হয়েছে বা হচ্ছে সেটির প্রতিবাদ খুব জোরেশোরেই হওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা অনেক ভয়ে রয়েছেন। অনেকেই হল ছেড়েছেন।

এবার আসি কোটা সংস্কার প্রসঙ্গে। আমি জোরালোভাবেই মনে করি, প্রতিবছর কোটার বর্তমান অবস্থা নিয়ে মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। কোন কোন ক্ষেত্রে কোটা দরকার, কাদের দরকার, সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা দরকার। কোটা যদি পূরণ না হয় সে ক্ষেত্রে কীভাবে খালি স্থান পূরণ হবে সেটিরও সুনির্দিষ্ট কৌশল থাকতে হবে। কোটার সুযোগ জীবনে একবারই ব্যবহার করার নিয়ম অচিরেই করা প্রয়োজন এবং কোটার সুযোগ পরিবার থেকে একজন পাবে– এটা করা গেলে কোটাভুক্ত অনেকেই এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে। তা না হলে কোটা কুক্ষিগত হচ্ছে অল্প কয়েক পরিবার এবং কোনো কোনো গোষ্ঠীর কাছে।
এখন খুব জোরালো প্রশ্ন, কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে এত কথাবার্তা? এর মূলে রয়েছে হয়তো একাধিক কারণ। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থাকার কারণেই ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিতে চাইছে অসাধু অনেকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্মগ্রহণ করেও এই সনদপ্রাপ্তি ঘটেছে। কয়েকজন সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জাল নিয়েও তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের বেশির ভাগই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হননি এবং তাদের সন্তান বেশির ভাগই কোনোভাবে এ কোটাভুক্ত হতে পারেননি।

এ বিষয়টির সুরাহা অনেক আগেই হতে পারত। কোনো কিছু নিয়ে আন্দোলন হলেই সেটিকে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং বিরোধী দলের ‘ভূত’ হিসেবে প্রচার না করে যে কোনো দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার পরিবেশ জারি রাখাই সরকারের কাছে প্রত্যাশিত। এটি গণতন্ত্রের জন্য জরুরি এক চর্চা। কিন্তু আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখি। সব সময় সব আন্দোলন বা দাবি সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তাও নয়। কিন্তু আলোচনার আগ্রহটা খুবই জরুরি। ‘ট্যাগ’ দিয়ে আন্দোলনকে খারিজ করার বিপরীতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও গ্রহণযোগ্য এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ আমরা আশা করি।

আমাদের আরও খেয়াল রাখতে হবে, ‘রাজাকার’ শব্দের প্রতি আমাদের চিরস্থায়ী ঘৃণার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য প্রতিশ্রুতি যেমন সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের প্রতিও আমাদের পূর্ণ প্রতিজ্ঞা স্থাপন জরুরি। তাই দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব।

You May Also Like