একটি টেক্সটাইল কারখানার কর্মকর্তা অনিমেশ চন্দ্র সাহা ও শাহজাহান মিয়া গত ১০ অক্টোবর বিকেলে উত্তরায় আল–আরাফাহ্ ব্যাংক থেকে ৪৮ লাখ টাকা তুলে প্রাইভেট কারে চড়ে বনানীর অফিসের উদ্দেশে রওনা হন। তাঁদের গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর একটি প্রাইভেট কার তাঁদের থামতে সংকেত দেয়। গাড়ি থামাতেই র্যাব পরিচয়ে পাঁচ থেকে ছয়জন গাড়িতে উঠে পড়েন। তাঁদের কাছে অবৈধ অস্ত্র আছে বলে দুজনকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ, মুখ বেঁধে ফেলেন। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে ৩০০ ফুট রাস্তায় নিয়ে যান। দুজনের কাছ থেকে ৪৮ লাখ টাকা ছাড়াও তিনটি মুঠোফোন এবং কোম্পানির খালি চেকবই ছিনিয়ে নেন তাঁরা। এ ঘটনায় সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে ডাকাতির ২৩ লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়।
সড়কে আটকে টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার খবর প্রায়ই শোনা যায়। এর সঙ্গে রাজধানীতে বাসাবাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে মালামাল লুটে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত ২৭ জুন রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের একটি বাড়ির তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে ঢুকে পরিবারের সদস্যদের হাত-পা বেঁধে ৩০ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ ১১ লাখ টাকা লুট করে নেয় এক দল ডাকাত। ভুক্তভোগী গৃহকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘ছয়-সাতজন ডাকাত ঢুকে ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে পুরো বাসা তছনছ করে। তাদের মধ্যে দুজনের মাস্ক পরা ছিল। সবার বয়স আনুমানিক ২৫-৩০ বছর। তাদের হাতে ছুরি ও চাপাতি ছিল।’
রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনা বাড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে পুলিশের তথ্যেও। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গত তিন বছরের (২০২১-২০২৩ সাল) তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডাকাতির পাশাপাশি ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেড়েছে।
ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নগরে ডাকাতির মামলা হয় ২৩টি। পরের বছর সেই মামলার সংখ্যা বেড়ে হয় ২৭। আর ২০২৩ সালে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪টিতে। এর আগে ২০১৯ ও ২০ সালে ঢাকা মহানগরে ডাকাতির ঘটনায় ২১টি করে মামলা হয়েছিল।
ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণ
রাজধানীতে ছিনতাইয়ের খবর প্রায়ই শোনা যায়। ছিনতাইকারীর ছুরিতে কারও কারও প্রাণ যাচ্ছে। গত বছর ১৬ জুলাই রাতে ধানমন্ডির শেখ জামাল ক্লাবের মাঠের পূর্ব পাশের ফুটপাতে ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হন আদনান সাঈদ ওরফে রাকিব (১৮) নামের এক কলেজছাত্র। এরপর ৩১ জুলাই গভীর রাতে গুলিস্তান এলাকায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে জাকির হোসেন (৪৩) ও তাঁর ছেলে জসিম উদ্দিন (১৭) আহত হন। কারওয়ান বাজারে তাঁদের মুরগির দোকান আছে। দুটি মোটরসাইকেলে করে আসা চার ছিনতাইকারী বাবা–ছেলেকে ছুরিকাঘাত করে ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। একই দিন বিকেলে মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদে ইমন মিয়া (১৭) নামের এক শিক্ষার্থীর গলায় ছুরি ধরে মুঠোফোন ও টাকাপয়সা নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে ঢাকায় ৬৩টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়। পরের বছর ২০২২ সালে সেই মামলার সংখ্যা বেড়ে ১০৩টিতে পৌঁছায়। পরের বছরও ছিনতাইয়ের ১০৩টি মামলা হয়।
গত বছর সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (এসআইভিএস) নামের একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে অপরাধীদের তথ্যভান্ডার গড়ে তোলে ডিএমপি। তাতে রাজধানীতে ছিনতাইয়ে ১ হাজার ৭৩৭ জন যুক্ত থাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী, ডাকাত ও অপহরণকারী পুলিশের তেজগাঁও বিভাগে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীর একেক এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান একেক রকম। যেমন গুলশানে উচ্চবিত্তের বসবাস আর মোহাম্মদপুর এলাকায় নিম্নমধ্যবিত্তের বাস। মোহাম্মদপুরের বছিলা ও বেড়িবাঁধ এলাকা এবং আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় বস্তি রয়েছে। সেখানে ভাসমান ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। এদের একটি অংশ অপরাধে যুক্ত। তিনি বলেন, ঢাকাসহ একাধিক জেলার প্রবেশপথ মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ দিয়ে। কাজেই এ এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটিয়ে অপরাধীরা সহজেই ঢাকা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। তাই ছিনতাই–ডাকাতির ঘটনা এই এলাকায় বেশি ঘটে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ২০২১ সালে রাজধানীতে চাঁদাবাজির ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছিল। ২০২২ সালে চাঁদাবাজির মামলা বেড়ে হয় ৫৯টি। ২০২৩ সালে চাঁদাবাজির মামলার তথ্য আলাদা করে সংরক্ষণ করা হয়নি বলে জানান ডিএমপির সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এই মামলার তথ্য অন্য খাতের মামলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ২০২৩ সালে ডিএমপিতে অন্যান্য খাতে মোট ৮ হাজার ৭টি মামলা হয়। এর আগে ২০১৯ সালে ডিএমপিতে চাঁদাবাজির ঘটনায় মামলা হয়েছিল ১৮টি। পরের বছর সেই মামলা বেড়ে হয় ২২টি।
ডিএমপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে রাজধানীতে অপহরণের ঘটনায় ৪৯টি মামলা হয়। ২০২২ সালে অপহরণের মামলা আর বাড়েনি। তবে ২০২৩ সালে এ মামলা বেড়ে হয় ৫৯টি।
পুলিশের ব্যস্ততা অন্যদিকে
ঢাকায় কেন ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি ও অপহরণ বাড়ছে, সে বিষয়ে পুলিশের কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মহিদ উদ্দিন বলেন, এসব অপরাধ নিয়ে ডিএমপির গবেষণা নেই, তাই সুনির্দিষ্ট করে কারণ বলা যাচ্ছে না। এসব অপরাধ বাড়ার পেছনে সমাজ ও রাজনীতির বহু কারণ থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ ধরনের অপরাধ বাড়ার পেছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ অনেক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান সাবের আহমেদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক কারণগুলো ছাড়াও অপরাধের মাত্রা ও ধরন কমিয়ে আনতে পুলিশ সময় দিতে পারে না। পুলিশ রাজনৈতিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন কাজে বেশি ব্যস্ত থাকে। যার ফলে অপরাধের ধরন ও সংখ্যা দুটিই সার্বিকভাবে বেড়ে যায়।