সমকাম বিদ্বেষ কী কোন রোগ? চিকিৎসা করিয়ে কি একে সারিয়ে তোলা যায়?

একটা সময় মনে করা হতো সমকামিতা একটি অসুখ। তাই সেটি সারিয়ে তোলার নানা পদ্ধতি বিভিন্ন সমাজে অবলম্বন করা হয়েছে।

কিন্তু বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরা এখন একমত যে একজন মানুষ কোন ধরনের যৌনতার প্রতি ঝুঁকবেন, তিনি একই লিঙ্গের কারোর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবেন নাকি বিপরীত লিঙ্গ বা উভয় লিঙ্গের প্রতি সেটি চাইলেই বদলে দেয়া যায়না।

একটি ব্যাপারে বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এখন মোটামুটি একমত যে যা অসুখ নয় তা সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৩ সালে সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেটি করেছিলো ১৯৯০ সালে। কিন্তু ইদানীং মনোযোগ পাচ্ছে ‘হোমোফোবিয়া’ বা সমকামীদের প্রতি ঘৃণা ও বিরূপ মনোভাবের বিষয়টি।

এটি কি অযৌক্তিক ভীতি?

‘ফোবিয়া’ শব্দটির এসেছে গ্রিক থেকে। যার অর্থ কোন কিছুর প্রতি অযৌক্তিক ভীতি।

১৯৬০ সালে মার্কিন মনোবিজ্ঞানী জর্জ ওয়েইনবার্গ প্রথম ‘হোমোফোবিয়া’ শব্দটি তৈরি করেন।

তিনি তার সোসাইটি অ্যান্ড দ্যা হেলদি হোমোসেক্সুয়াল বইয়ে লিখেছিলেন, “কোন রোগীকে আমি সুস্থ মনে করবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সমকামীদের প্রতি তার বিদ্বেষ কাটিয়ে উঠতে পারবেন।”

ইতালির রোমে এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেডিকেল সেক্সোলজির একজন অধ্যাপক ইমানুয়েল এ জানিনি।

তিনি উল্টো হোমোফোবিয়াকে মানসিক অসুখ বলে বর্ণনা করেছেন।

২০১৫ সালে জার্নাল অফ সেক্সুয়াল মেডিসিনে এই বিষয়ে তার একটি গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।

বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি হোমোফোবিকদের ‘দুর্বল-চিত্তের ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

তিনি তার গবেষণায় হোমোফোবিয়াকে সাইকোসিটিসিজমের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন।

সাইকোসিটিসিজমের সাথে রাগ ও আগ্রাসী মনোভাবের সম্পর্ক রয়েছে। হোমোফোবিয়াকে তিনি অবচেতন নিরাপত্তা-হীনতার সাথেও সম্পর্কিত বলে মনে করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯০ সালে সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়।

ছবির উৎস,EPA

ছবির ক্যাপশান,বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯০ সালে সমকামিতাকে মানসিক রোগের তালিকা থেকে সরিয়ে নেয়।

হোমোফোবিয়ার মাত্রা

অধ্যাপক জানিনি তার গবেষণায় হোমোফোবিয়ার মাত্রা মাপার চেষ্টা করেছেন।

সেজন্য তিনি ৫৫১ টি ইতালিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর জরিপ চালিয়েছেন।

এরপর অন্য ধরনের মানসিক রোগের সাথে তার একটি তুলনা করেছেন।

তার মতে যে ব্যক্তির মধ্যে হোমোফোবিয়া বা সমকামিতায় যত বেশি ঘৃণা তার মধ্যে সাইকোসিটিসিজমের মাত্রাও বেশি।

তিনি মনে করেন হোমোফোবিয়া একটি মানসিক ব্যাপার যা থেরাপির মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব।

সংস্কৃতির ক্ষমতা

কিন্তু ব্যক্তির মানসিকতা তার আশপাশের পরিবেশ দ্বারা নির্মাণ হয়ে থাকে।

অন্য একটি গবেষণায় জানিনি দেখার চেষ্টা করেছেন সমাজ ও সংস্কৃতি কিভাবে অতিমাত্রায় পুরুষালী-ভাব বা নারী বিদ্বেষের বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

তার সাথে হোমোফোবিয়ার সম্পর্ক আছে কিনা সেটি দেখার চেষ্টা করেছেন তিনি।

ব্রাজিলে সমকামীদের সারিয়ে তোলার একটি থেরাপির উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানীরা।

ছবির উৎস,AFP

ছবির ক্যাপশান,ব্রাজিলে সমকামীদের সারিয়ে তোলার একটি থেরাপির উপরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানীরা।

২০১৭ সালে তার দল তিনটি দেশের ১০৪৮ জন শিক্ষার্থীদের উপর গবেষণা চালায় যারা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী।

তিনটি দেশ হল ক্যাথলিক খ্রিষ্টান প্রধান দেশ ইতালি, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আলবেনিয়া এবং ইউক্রেন যেখানে প্রাচীনপন্থী খ্রিষ্টানদের প্রাধান্য রয়েছে।

জানিনি বলছেন, “এখানে সবচাইতে চমকপ্রদ বিষয় হল ধর্ম নিজে সমকামীদের প্রতি ঘৃণার সাথে সম্পর্কিত নয়। মূলত গোঁড়া ধর্মীয় বিশ্বাসই এক্ষেত্রে হোমোফিবিয়ার মাত্রা তৈরিতে বেশি ভূমিকা রেখেছে।”

প্রাচীনপন্থী খ্রিস্টধর্মে সমকামিতা পাপ। তবে উদারপন্থীরা বলে চার্চ হোমোফোবিয়া অনুমোদন করেনা।

ভাষার ভূমিকা

টিয়েরনান ব্রেডি আয়ারল্যান্ডে এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন।

তিনি বলছেন, “এতে কোন সন্দেহ নেই যে অনেক সময় গির্জার নেতারা যেসব ভাষা ব্যবহার করেন সেটি এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর প্রতি ভীতি ও ক্ষোভ তৈরি করে।”

গবেষণা বলে যৌন সংখ্যালঘুদের প্রতি ধর্মীয় নেতাদের মনোভাব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে।

ছবির উৎস,AFP

ছবির ক্যাপশান,গবেষণা বলে যৌন সংখ্যালঘুদের প্রতি ধর্মীয় নেতাদের মনোভাব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারে।

ব্রেডি বিষয়টি নিয়ে আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চে প্রচারণা চালানোর চেষ্টা করছেন।

তার মতে, “আমরা হোমোফোবিক হিসেবে জন্ম নেই না। যৌন সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা পরে শিক্ষালব্ধ একটি বিষয়। কোথাও থেকে এটি আমরা ধারণ করি।”

তিনি বলছেন, “চার্চ অবশ্য মাত্র একটি মাধ্যম যেখানে এই ঘৃণার মনোভাব জন্ম নেয়। এছাড়াও এর আরো অনেক উৎস রয়েছে। যেমন ক্রীড়া, রাজনীতি, সমাজ।”

তবে তিনি মনে করছেন, এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশ্বব্যাপী মনোভাব পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাতে তাদের প্রতি আগ্রাসী ভাষা রাতারাতি পাল্টে যাবে।

গতানুগতিক চিন্তার ফল

প্যাট্রিক আর গ্রাজাংকা যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক।

তার গবেষণা বলছে হোমোফোবিয়ার সাথে গতানুগতিক চিন্তার সম্পর্ক রয়েছে।

২০১৬ সালে তিনি তার গবেষণার জন্য ৬৪৫ জন মার্কিন কলেজ শিক্ষার্থীর উপর কাজ করেছেন।

চার রকম বিশ্বাস বা ধারনা নিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো।

প্রাচীনপন্থী খ্রিস্টধর্মে সমকামিতা পাপ। তবে উদারপন্থীরা বলে চার্চ হোমোফোবিয়া অনুমোদন করেনা।

ছবির উৎস,AFP

ছবির ক্যাপশান,প্রাচীনপন্থী খ্রিস্টধর্মে সমকামিতা পাপ। তবে উদারপন্থীরা বলে চার্চ হোমোফোবিয়া অনুমোদন করেনা।

সেগুলো হল যথাক্রমে, একজন যৌন সংখ্যালঘু ব্যক্তি তার যৌনতা জন্মগত-ভাবেই অর্জন করেন।

কোন একটি নির্দিষ্ট যৌন গোষ্ঠীর সবাই যেমন সমকামী পুরুষ বা নারীরা সবাই একই রকম হয়ে থাকেন।

কোন একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র একটি যৌন গোষ্ঠীর অংশ হয়ে থাকেন।

চতুর্থটি হল একটি যৌন গোষ্ঠীর একজনের সাথে পরিচয় হলে তাদের মতো সবাইকে জানা হয়ে যায়।

দেখা গেলো প্রথমটি অর্থাৎ ‘একজন যৌন সংখ্যালঘু ব্যক্তি তার যৌনতা জন্মগত-ভাবেই অর্জন করেন’ এই ধারনাটি সবচাইতে বেশি শিক্ষার্থী সমর্থন করে।

সমকামী অথবা বিপরীত লিঙ্গের সাথে সম্পর্ক করেন এমন সব ধরনের শিক্ষার্থীরাই এমন মনে করনে।

কিন্তু যারা এলজিবিটি গোষ্ঠীর প্রতি সবচাইতে নেতিবাচক ধারনা প্রকাশ করলেন তারা অন্য তিনটি বিষয়ই বেশ গোঁড়াভাবে বিশ্বাস করেন বলে ঐ গবেষণায় দেখা গেছে।

তবে গবেষকরা মনে করছেন ইদানীং এলজিবিটি গোষ্ঠীর ব্যক্তিরা বেশি করে তাদের যৌনতা সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলার ফলে তাদের অধিকার আরো বেশি স্বীকৃতি পাচ্ছে।

যেসব দেশে সমকামিতা রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে হোমোফোবিয়া বেশি হয়ে থাকে।

ছবির উৎস,Reuters

ছবির ক্যাপশান,যেসব দেশে সমকামিতা রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে হোমোফোবিয়া বেশি হয়ে থাকে।

You May Also Like