২০১৬ সালে ঢাকার কলাবাগানে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যার পর থেকেই বাংলাদেশের সমকামীরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন। চাপা পরে গেছে এই ‘ইনভিসিবল মাইনরিটি’-র মানবাধিকার রক্ষার সকল দাবী। ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট এ হত্যা মামলায় ছয় জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও তেমন পাল্টায়নি দেশের পরিবেশ, বলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সমকামী অধিকারকর্মী।
এই অধিকারকর্মী পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। আর দশটা ছেলের মতই তার বেড়ে উঠা। পড়তেন ঢাকার এক নামকরা বাংলা মাধ্যম স্কুলে। বয়ঃসন্ধির সময় থেকে সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে শুরু করেন তিনি। ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আমি একা না, আমার ক্লাসে আরও চারজন ছিল।” কলেজ ইউনিভার্সিটি জীবনে তিনি আরও বহু সমকামী পুরুষ ও নারীর দেখা পান।
ছয় বছর হল সমকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তিনি। বাসায় অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা পেরুতে হয়েছে তাকে। “ফ্যামিলি থেকে কেউ মানেই না”, তিনি বলেন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় বাসা থেকেও বের করে দেয়া হয়েছিল একবার। এখনও বাব-মার মধ্যে একজন মেনে নেননি তাকে।
মূলত ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশে সমকামীরা আত্মপ্রকাশ শুরু করে। কিন্তু জুলহাজ-তনয় হত্যার পর থেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে সমকামীদের মানবাধিকার রক্ষার দাবী হারিয়ে গেছে। ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটি ধীরে ধীরে সমাজে স্বীকৃতি পেতে শুরু করলেও সমকামী নারী বা পুরুষেরা এখনও আত্মগোপন করে থাকেন আতঙ্কে, বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই অধিকারকর্মী, “কেউ জানে না, কেউই জানে না। শুধু সারভাইভ করাই একমাত্র অপশন”।
বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও নিজের পরিচয় প্রকাশ করা ঝুঁকিপূর্ণ বলেন তিনি। ভাই-বোনেরা সবার আগে চড়াও হয়। তিনি আরও বলেন, সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেন সমকামীতা কোন মানসিক ব্যাধী। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ যখন জানায় যে এটা মানসিক কোন সমস্যা নয়, বরং প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ব্যাপার, তখনও থামে না নির্যাতন। বাসায় আটকে রাখা, মার দেয়া, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা – বাংলাদেশে সমকামীদের জীবনে এসব অহরহ ঘটছে। কোন কাছের বন্ধুর কাছে নিজের যৌন অভিমুখিতা প্রকাশ করে ফেললে দেখা যায়, গোপন কথা দ্রুত পাঁচকান হয়ে যায়। তারপর থেকে শুরু হয় সামাজিক নিগ্রহ।’হোমোফোবিয়া’ এ সমাজে এতটাই প্রকট যে পরিচয় প্রকাশ পেলেই একরকম একঘরে হয়ে যেতে হয়। কর্মক্ষেত্রে চাকরি হারানোর নজিরও আছে অনেক, বলেন তিনি।
২০১৭ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে সমকামী সন্দেহে ২৭ জন পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের কারণে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মন খুলে এ ব্যাপারগুলো আলোচনা করা যায় না। কিছু প্রাইভেট গ্রুপ আছে, যেখানে সমকামীরা নিজেদের সাথে যোগাযোগ করে। তবে এসব গ্রুপের কর্মকান্ড মুলতঃ ডেটিং পার্টনার খোঁজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অ্যাক্টিভিসম বা বৈরী পরিবেশের সাথে লড়াই করার মানসিক আর সামাজিক সহযোগিতা তেমনটা পাওয়া যায় না বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
অনেক দেশ সমকামিতাকে বৈধতা দিলেও, বর্তমানে বাংলাদেশের যে অবস্থা, এখানে সমকামীদের স্বীকৃতি প্রদানের সম্ভাবনা নেই অদূর কোন ভবিষ্যতে৷ যাদের সামর্থ্য বা যোগ্যতা আছে, তারা প্রথম সুযোগেই চলে যান দেশ ছেড়ে। যারা যেতে পারেন না, নিজের পরিচয় গোপন করে ভয়ে ভয়ে কাটাতে হয় জীবন। এক্টিভিসমও এখন মাইক্রো লেভেলে চলে এসেছে – হাতে গোনা যায়, এমন ছোট ছোট সার্কেল নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেন এখনকার সমকামী অধিকারকর্মীরা। নিরাপত্তার স্বার্থে ভিসিবল পলিটিক্সে যাবার কোন আগ্রহ নেই। “কেবল অল্পকিছু মানুষকে এম্পাওয়ার করাটাই সম্ভব এখনকার বাস্তবতায়,” বলেন তিনি।
ফ্যামিলি থেকে বিয়ের জন্য প্রচুর চাপ আসে। ছেলেরা অনেক সময় পাশ কাটিয়ে যেতে পারলেও লেসবিয়ান মেয়েদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। অনেক মেয়েই ‘বিয়ের জন্য সেফ’ গ্যে ছেলের খোঁজ করে। “শেষ রক্ষা হয় না তবুও”, বলেন তিনি। জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় অনেককে। ‘স্বামী’ কর্তৃক নিয়মিত ধর্ষণের শিকার হতে হয়, এমন অনেক লেসবিয়ান নারীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন বলে জানান তিনি।
কমিউনিটির ভবিষ্যত নিয়ে কোন আশার আলো দেখতে পান না। আত্মহত্যার প্রবণতা কমিউনিটি মেম্বারদের মধ্যে বেশ প্রবলভাবে রয়েছে বলে জানান তিনি। মিডিয়াতে প্রায়ই কিছু সুইসাইডের নিউজ আসে, যার কোন কারণ দেখানো হয় না। “আমরাতো জানি, তারা কমিউনিটিরই কেউ ছিল”, বলেন তিনি, “সব ধামাচাপা দেয়া হয়।”
গ্যে ও লেসবিয়ান কমিউনিটিতে বাই-সেক্সুয়াল বা উভকামীদের নিয়ে অনেক ভীতি আছে, ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন সাংবাদিক তানজিয়া (২৭)। বাই-সেস্কুয়াল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তিনি তিন-চার বছর আগে। বন্ধুবান্ধবরা প্রায় সবাই জানেন, তবে বাসায় কাউকে জানাননি এখনও। “কমিউনিটি থেকে হেট করে, মনে করে একসময় কোন ছেলেকে বিয়ে করে ‘নরমাল’ লাইফ লিড করা আমাদের এন্ডগেইম”, ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন তিনি। তবে এর জন্য দেশের গ্যে ও লেসবিয়ান কমিউনিটির সার্বক্ষণিক ইন্সিকিউরিটি এবং শিক্ষার অভাবকে দায়ী মনে করেন তিনি।
তানজিয়া ১৮ বছর বয়সে প্রথম বুঝতে পারেন যে তিনি পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি সমানভাবে আকৃষ্ট। “নিজের আইডেন্টিটি নিয়ে অনেক স্ট্রাগল করেছি,” বলেন তিনি, “তখনও বাই-সেক্সুয়ালিটি কেন, সেক্সুয়ালিটি নিয়েও কিছুই জানতাম না।” ফেসবুক পেজ ‘রঙিন দেশ’-এ অনেকের অনেকের কাহিনী পড়েন, জানতে পারেন নিজের সম্পর্কে। সেখান থেকে কমিউনিটির অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে।
তানজিয়া বলেন “অনেকেই সাহায্য চায় অনলাইনে। মোস্ট অফ দ্যা পিপল আর লোনলি, দে জাস্ট ওয়ান্ট টু টক, দে নিড কাউন্সিলিং।” তার মতে, বাংলাদেশে গ্যে, লেসবিয়ান বা বাই-সেক্সুয়ালরা এত বেশি চাপা ত্রাসের ভেতর থাকে যে সমমনা কারও সাথে শুধু কথা বলতে পারলেও মনটা অনেক হালকা হয়। “যখন বুখতে পারি যে কেউ আত্মহত্যা করার কাছাকাছি চলে গিয়েছে, কথা বলার চেষ্টা করি, আশ্বাস দিই সাধ্যমত।”
“ফার্স্ট চান্সে এ দেশ ছেড়ে চলে যাব” বলেন তানজিয়া, “গোঁড়া ধর্মান্ধতার এদেশে সমকামীদের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব না। সুদূর ভবিষ্যতে হয়তোবা সমকামীরা মানুষ হিসেবে গণ্য হতেও পারে…”।
“বাংলাদেশে সমকামী সম্পর্কের কোন আইনগত বিধান নেই”
“বাংলাদেশে সমকামী সম্পর্কের কোন আইনি বিধান নেই”, বলেন আইনজীবী এহতেশাম রহমান খান। ১৮৬০ সালে প্রণীত ব্রিটিশ পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমকামীতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ – যার কারণে দশ বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে। বাংলাদেশসহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত সকল দেশেই এ আইনটি প্রচলিত ছিল। ১৯৬৭ সালে সেক্সুয়াল অফেন্সেস এক্ট পাশ করার মাধ্যমে ব্রিটেনে সমকামীতাকে ডিক্রিমিনালাইজ করা হয়। ২০১৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৩৭৭ ধারা রদ করে সমকামীতা কোন অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ ধারা অনুযায়ী “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী” বলা হলেও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এ ধারা এখনও বলবদ রয়েছে, বলেন এডভোকেট খান।
“সমকামীতা নিয়ে সীমিত আকারে গবেষণা থাকলেও কোনও সংঘবদ্ধ রিসার্চ নেই”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যাান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর তানিয়া হকের মতে, সামাজিক ও ধর্মীয় জায়গা থেকে সমকামীতাকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে দেখা প্রয়োজন। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, এদেশে সমকামীতা নিয়ে সীমিত আকারে গবেষণা থাকলেও কোনও সংঘবদ্ধ রিসার্চ নেই। হেটেরোসেক্সুয়ালিটি প্রজননের মাধ্যমে মানবসম্পদ তৈরিতে সাহায্য করে, আর হোমোসেক্সুয়ালিটি হল মানবাধিকারের জায়গা। সমতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।
ট্রান্সজেন্ডার এবং হিজড়া সম্প্রদায়কে ইদানিং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে হ্যান্ডিক্যাপডদের কর্মক্ষেত্রে ইন্টিগ্রেট করা হচ্ছে। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সমকামীদের ইম্প্যাক্ট এনালাইসিস করা গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি। “দেশে কতজন সমকামী আছেন, সমকামীতার সায়েন্টিফিক র্যাশনালিটি কি – এসব ব্যাপারে কমপ্রিহেনসিভ গবেষণা হওয়া দরকার”, তিনি বলেন।